আমারা সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার প্রথম পর্ব এই ব্লগে পাবলিশ হবার পরে অনেকেই তা অত্যন্ত পছন্দ করেছেন এবং পরবর্তি পর্ব লেখার জন্য আমাকে ফেসবুকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি নিজেই সেই গল্প লিখতে গিয়ে এত বেশী নস্টালজিক আর আবেগ প্রবণ হয়ে পরেছিলাম যে আমি সিদ্ধান্ত নিই আবার এই ট্যুরে যাবো। তাই আগেরবারের শুরুর পর্ব সেখানেই শেষ করে দিচ্ছি। তারপর থেকে নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখব এখন। যদি কেউ আগের পর্ব না পড়ে থাকেন এখানে গিয়ে পড়ে আস্তে পারেনঃ আগের পর্বের লিংক

আগেরবার আমরা 2018 সালে আমরা এই ট্যুরে গেছিলাম বাসে। নতুন করে করে 2023 এ গেছিলাম বাইক নিয়ে। যদিও আগেও তিন বার এই ট্যুর করতে গিয়ে নানা কারণে ব্যার্থ হয়েছি। তবে এই বার ভালোভাবে শেষ করে ফিরতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ্‌। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং থানচির চেহারের এক আমূল পরিবর্তন দেখে বেশ অবাক হয়েছি। এখনকার থানচি আর আগের থানচি নাই। বছর খানেক আগে আগুন লেগে পুরো থানচি বাজার পুড়ে যাওয়ার পর নতুন করে অনেক বিল্ডিং হয়েছে, মার্কেট হয়েছে। এখন থানচি দেখতে প্রায় বান্দরবন শহরের মত উন্নত!

থানচি থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত রোমাঞ্চকর নৌকা ভ্রমণ

বাইক থানচিতে পার্ক করে রেখে আমাদের গাইডকে সাথে নিয়ে প্রথমদিনে নৌকা যোগে 5 ঘণ্টায় রেমাক্রী ফলস এ পৌঁছানোর কথা থাকলেও মাঝ নদীতে আমাদের নৌকা নষ্ট হয়ে যায়। অনেকবার ঠিক করে কিছুটা এগোতেই আবার নষ্ট হয়। এভাবে এক পর্যায়ে আমরা নৌকার আশা ছেড়ে দিয়ে সাঙ্গু নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। এদিকে নৌকার মাঝি আর গাইড মিলে নৌকা ঠেলে ঠেলে রেমাক্রী পর্যন্ত নিয়ে যায়। প্রায় 3 ঘণ্টা নদীর পাশে দিয়ে হেঁটে রাত 10 টায় আমরা রেমাক্রী পৌঁছেছিলাম।

এবড়ো থেবড়ো পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে হাটতে কষ্ট হলেও চাঁদের আলোয় সাঙ্গুর এক অন্যরূপ দেখেছি আমরা। যা বেশিরভাগ পর্যটক কখনো দেখতে পান না। কখনো হাঁটু পানিতে নেমে আবার কখনো নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নানান গল্পে মুখরিত হয়েছিল চলমান আড্ডা। বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা জুড়ে জনমানবের চিন্হ নেই, শুধু আমরা 3 জন চাঁদের আলোয় হাঁটছি। মাঝে মাঝে দু একটা জুম ঘর দেখতে পেয়ে কিছুটা সস্তি হচ্ছিল। রাতে রেমাক্রী পাড়ার সাবেক চেয়ারম্যান এর কটেজে উঠে ভাত, ডাল আর ডিম ভাজি যেন রাজ্যের সুস্বাদ কে হার মানাচ্ছিল। কাঠের কটেজে শক্ত বিছানায় শুয়ে সে কি ঘুম…!!! আহা…!

ছবিগুলো পরেরদিন সকালে রেমাক্রী ফলস এ তোলা।

রেমাক্রি থেকে নাফাখুম ট্র্যাকিং

শুধু এক রেমাক্রী আর সাঙ্গুর সৌন্দর্যের বর্ণনায় বসে যদি কোন সাহিত্যিক কাব্য থেকে মহাকাব্য লিখে ফেলে তবুও তা আমার মনে কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সূত্রপাত ঘটাবেনা বরং মহাকাব্যের ইতি টানতে পেরেছে বলে সাহিত্য কল্পনার অকাল মৃত্যু ঘটেছে মনে হবে…।

নাফাখুমের সৌন্দর্য দেখার আগে সেখানে পৌঁছানোর সময় যাত্রাপথের যেই নয়ানভিরাম সৌন্দর্যের দেখা মেলে তা মনের গভীরের সৌন্দর্য তৃষ্ণা যেন মিটিয়ে দেয়। দুইপাশে পাহাড় মাঝখানে নদীর পাড় ধরে আমরা হেঁটে চলেছি। স্বচ্ছ সুন্দর পানযোগ্য পানি কুলকুল শব্দে সর্বদা প্রবাহিত হচ্ছে। পৃথিবীর বুকে এক টুকরো নদীর সৌন্দর্য যদি এমন হয় তবে না জানি জান্নাতের সেই স্রোত, সেই ঝর্ণার সৌন্দর্য কত হবে…। আলহামদুলিল্লাহ্‌!

হেঁটে চলেছি সৌন্দর্য দেখতে দেখতে
যাত্রাপথে দোকানে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে চিপস খাওয়া
প্রশান্তিময় পানির শব্দ

গীরিপথের দুপাশের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য দেখতে দেখতে প্রায় 4-5 ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছে যাই নাফখুমের কাছে। 2018 এর ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবার গেছিলাম নাফাখুমে। 5 বছর পর আবার গিয়ে দেখলাম একটি ঝুলন্ত ব্রিজ হয়েছে। আশেপাশে দোকান এবং খাবার ব্যাবস্থা হয়েছে।

এতো রোদে ভারী ব্যাগ কাধে নিয়ে এতটা পথ পাড়ি দেবার পরে আমরা সবাই বেশ ক্লান্ত। তাই এতো সুন্দর পানির স্রোতধারার দেখা পেয়েই সবার প্রথমে আমাদের মাথায় আসে আগে গোসল করতে হবে। 😄😄😄 অতঃপর তিন জনেই লাইফ জ্যাকেট পরে নফখুমের ঠান্ডা পানিতে নেমে গোসল করলাম। গোসলের সময়ের কোন ছবি তোলা হয়নি বলে দিতে পারছিনা।

IMG 20230202 143158
ঝুলন্ত ব্রিজ, নিচে নাফাখুম

নাফখুমে গিয়ে ক্লান্ত শরীরে যখন ঠান্ডা পানিতে ঝাঁপ দিলাম মনে হচ্ছিল শরীরের সমস্ত ব্যাথা, ক্ষত সব কিছুই যেন পানির ক্রমাগত চলা স্রোতধারায় ধুয়ে মুছে নিয়ে গেল। সেই স্রোত ধারায় মিশে গেল মনের সমস্ত একাকীত্ব, স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা আর মন খারাপের বিন্দু বিন্দু কনা…। পরে রইলো শুধু এক রাশ প্রশান্তি…।

waterfall

নাফাখুমে বসে আমাদের জীবনের সেরা লাঞ্চ করার অভিজ্ঞতা

হুটোপুটি আর জলকেলি করে গোসল শেষ করার পর যখন উপরে আসলাম তখনি বুঝতে পারলাম যে পেটের ভিতর কয়েকশ ইদুরের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে 😰 😰 এখন সামনে পাথর দেখে পাথর ও খেতে মন চাচ্ছে। 😂 😂 😂

ভাগ্যিস গোছলে যাবার আগে খাবার অর্ডার দিয়ে গেছিলাম। তাই ওপরে উঠে কোন মত ভেজা কাপড় চেঞ্জ করেই বসে পড়লাম খেতে। মেনুতে ছিল: জুমের মোটা ধানের ঢেঁকিতে ভাঙ্গা লাল চালের ভাত, আলুভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি 😍 😍 আর আছে ক্রমাগত ঝরে পড়া পানির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। 😊

আহ্! অমৃত সেই খাবার। 5 স্টার হোটেলের বাবুর্চির হাতের রান্না নয় এ হলো 5 বিলিয়ন স্টার হোটেলের বাবুর্চির হাতের রান্না। ছেছরা পোড়া ডিম ভাজি, আলুভর্তা তে লবন হইছে কি হয়নি অথচ পিয়াজের জায়গা দেয়া যাচ্ছেনা। তবুও এক নিঃশ্বাসে খেয়ে উঠলাম। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়…। অথচ বাড়িতে মা, বোন, বউ এতো স্বাদের খাবার রান্না করার পরেও ভুল ধরি 😐😐😐 (sorry to all of them)

যাই হোক, এটা জীবনে সেরা লাঞ্চ এর মধ্যে একটা। আসলে খাবারের স্বাদ নির্ভর করে ক্ষুধার ওপর, আর ভালো লাগা নির্ভর করে পরিবেশন এবং পরিবেশের ওপর 😊😊😊

IMG 20230202 143834
খাওয়ার পর একটু পা ঝুলিয়ে জিরিয়ে নিই।

নাফাখুম থেকে থুইসাপাড়া যাত্রা

গোসল, খাওয়া শেষ করে আমরা নাফাখুম থেকে রওয়ানা দিই থুইসাপাড়ার উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে রাতে থাকবো। আমাদের সাথে মুরগি আছে সেটা ওখানে নিয়ে গিয়ে রান্না হবে, রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাবো। নাফাখুম পাড়া ছেড়ে আবার যখন হাঁটতে শুরু করলাম ততক্ষণে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। আলো অত্যন্ত কম। একদম ফ্রেশ মাইন্ড এবং শরীরে হাঁটতে শুরু করলেও সারাদিনের এত পরিশ্রমের পর ক্লান্ত শরীর আর যেন এগোচ্ছিল না। তাই একটু পরপরেই থামছিলাম আর জিরিয়ে নিচ্ছিলাম।

তখন শুধু মনে চাচ্ছিল কখন বিছানায় যাবো, কখন একটু ঘুমাবো। কিন্তু পথ এখনো অনেক বাকি। নাফাখুম থেকে যাবার সময় প্রচুর পরিমাণ বড়ো বড়ো পাথরের দেখা পাওয়া যায়। পাথরের উপর দিয়ে হাটা সহজ নয়। একটু এদিক সেদিক হলেই পাথরে লেগে পা কেটে যায়। আঁকাবাঁকা করে পা ফেলতে হয় তাই পায়ের গোড়ালি, তালু এবং অস্থিসন্ধিতে প্রচণ্ড ব্যাথা ধরে যায়, হাঁটুর লিগামেন্ট গুলো ব্যাথা সইতে না পেরে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু যত কষ্টই হোক না কেন গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে কারণ পরেরদিন সকালে আরও এক্সট্রিম এক এডভেঞ্চার অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য…।

সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত নামে তখন পাহাড় আর গিড়ি পথের এক অন্য রূপ সামনে আসে। অন্ধকার নামার সাথে সাথে হটাত করেই যেন পাহাড় আর প্রকৃতির অগোচরে লুকিয়ে থাকা এক অন্য জগত জেগে উঠে। জনমানবহিন এই পরিবেশে কিছুটা গা ছমছমে ভাব বিরাজ করে চারিদিকে। সন্ধ্যায় আলো কমে যাওয়ায় এরপরে আর কোন ছবি নিতে পারিনি। এখানে থেকে আরো ৩-৪ ঘণ্টা হেঁটে রাত ১০ টায় আমরা থুইসা পাড়া পৌঁছেছিলাম। ওখানে গিয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুম। পড়ের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন এডভেঞ্চারের উত্তেজনায় মন আনচান করছিল। কিন্তু ক্লান্ত শরীর, চোখে ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসিরা ততক্ষণে টিভি সিরিজ দেখতে বসে গেছে…।

সন্ধ্যায় নেওয়া ছোট একটা ভিডিও দিয়ে শেষ করতে চাই…।


Riham
Riham

আমি একজন সাধারণ ভাবনার সাধারণ ছেলে, যে গল্প বলতে ও গল্প শুনতে ভালোবাসে। কর্ম জীবনে যতটা এগিয়েছি সেটা পালনকর্তা দয়া ও ভালোবাসায়। একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা আমার। নিজের অবস্থানটা নিজে গড়িয়েছি বলেই পরিচয় দিই, তবে তা সঠিক নয়। উঠে আসার পেছনে অনেক মানুষের হাত আছে, অনেক গুলো অন্তরের দোয়া আছে আর স্রিষ্টিকর্তার দয়া আছে। গুরতর অসুস্থতা এবং এক্সিডেন্ট এ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি কয়েকবার। যে দিন গুলো কাটাচ্ছি সেগুলো বোনাস সময়। তাই বেশী ভাবনা চিন্তার তোয়াক্কা না করে মন চাইলেই বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পরি পাহাড়ের ডাকে সারা দিতে, ঝর্নার সাথে মাখামাখি করতে, অথবা ভাবনা গুলোকে নোনাজলে প্রশান্ত করতে। ছবি তুলতে ভালোবাসি, অবসরে অথবা গভীর রাতে একা বসে ভাবতে ভালোবাসি, প্রকৃতি দেখতে এবং বোঝার চেষ্টা করতে ভালোবাসি, গান শুনতে ও গলা মেলাতে ভালোবাসি। টিভি সিরিজ আর মুভি দেখার নেশা আছে কিছুটা। বাকি পরিচয়টা না হয় গল্পে গল্পে দেওয়া যাবে। 😊😊😊

Leave a Reply