ভুলে ভরা আমাদের জীবনটা, তারচেয়েও আরও অনেক বেশী ভুলে ভরা আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। তবে সামাজিকতা দ্বারা প্রভাবিত হলেও ভুলগুলো আমরা করবো কি করবোনা সেই চয়েস টা কিন্তু আমাদের হাতে থাকে। অর্থাৎ আমরা চাইলেই সমাজের নেগেটিভ দিক গুলোকে বর্জন করে পজিটিভ দিক গুলোকে গ্রহণ করতে পারি। তবে তার জন্য দরকার দৃঢ় সংকল্প আর নিজের নফসের গোলাম না হয়ে নফসকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করা। নফস বা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে এই মৌন লড়াইটার নাম জিহাদ। আমরা সাধারণত জিহাদ বলতে মারামারি বা যুদ্ধ করাকে বুঝি। নফসকে নিজের গোলাম বানাতে যে মারামারি বা যুদ্ধ আমরা করি সেটা সর্বশ্রেষ্ট জিহাদ। কারণ এই ক্ষেত্রে মনের জোর থাকতে হয় অনেক বেশী।

কেন আমরা নফস এর গোলাম হয়ে গেছি?

প্রথমেই জানা দরকার, চাহিদা বা আকাংখা সীমাহীন। নফস হচ্ছে আমাদের অন্তরাত্মায় সুপ্ত থাকা এক পশু, যার কাজ হলো সারাদিন খাই-খাই আর চাই-চাই করা। নফস বা আমাদের আকাংখা গুলোর এই ক্ষুধা যখন পায় আমরা ভাবি যে এই ক্ষুদা মিটালেই হয়তো শেষ। এর পরেই আমি শান্তি পাবো এবং সুখি হয়ে যাবো। কিন্তু বাস্তবে নফস এর এই চাহিদা সীমাহীন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একটু মিলিয়ে দেখুন তো নিচের কথা গুলোর সাথে আপনার মনে সুপ্ত থাকা কথার সাথে কিছুটা হলেও মিলে যায় কিনা?

  • আইফোন টা কিনতে পারলেই আমি শান্তি পাবো।
  • ওমুক দামি বাইকটা কেন আমি নিতে পারছিনা? এটা পেলেই আমার শান্তি হবে।
  • আমার একটা বিলাসবহুল গাড়ি দরকার।
  • ওমুকের ১৮ ভরী স্বর্ন আছে। আমার যদি ২০ ভরী সোনা থাকতো, আমি কতই না সুখি হতাম।
  • আলমারির অনেকটা জায়গা ফাঁকা আছে। কিছু দামি শাড়ি দিয়ে ভরানো দরকার।
  • আমার জামাই আমাকে গিফট দেয়না।
  • আমি যেই পোষ্ট এ চাকরি করছি তা দিয়ে হচ্ছেনা আরও প্রমোশন দরকার।
  • আজকাল কি আর এই টাকায় চলে? স্যালারিটা আরেকটু বাড়লে ভালো হতো। বস সব একাই খেয়ে দিচ্ছে।
  • আমার স্বামী আসলে একটা আসামি। কারণ সে মাস শেষে ইনকামের টাকাটা এনে আমার হাতে তুলে দেয়না।
  • কেন যে আমার স্বামীর তার বাবা-মা কে এত টাকা দিতে হবে? সব টাকা যদি আমাদের একার হত তাহলে আমার জীবনটা আরও কতই না সুখের হতো।
  • আমার বাবা অযথায় তার সম্পত্ত্বি গুলো ফেলে রেখেছে আমার নামে কেন যে দলিল করে দেয়না বুঝিনা।
  • অমুক জায়গায় আমার মায়ের কিছু সঞ্চয় করা টাকা আছে, যেদিন পাবো আমি কতই না সুখি হবো।
  • আমার ছেলে/মেয়ে টা অংকে এবার ১০০ পেয়েছে। সামনের বার এরচেয়েও বেশী পেতে হবে।
  • আমি আরও একটু ফেমাস হতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু টিকটক এ কেউ লাইক দিতেই চায়না।
  • সপ্তাহে একবার ফাস্টফুড খেয়ে কি মন ভরে? আমার স্বামীটা একটা বোকাচোদা। একটু বেশী টাকা কামাই করলেই প্রতিদিন ফাস্টফুড খেতে পারতাম।
  • কাজের মেয়েটা শুধু ঘর মুছেই চলে যায় কেন? আমার সব কাজ করে দিবে আর আমি রাজরানি হয়ে খাবো।
  • আমার এই ব্লগ পোস্ট ১০০ মানুষ শেয়ার করেছে, ইস যদি ১০০০ মানুষ শেয়ার করতো তাহলে আমাকে সবাই কতই না বাহবা দিত আর বলতো আমি কত ভালো লেখি।

এইযে কোথা গুলো বললাম এগুলো আমাদের মনের দৈনন্দিন চাহিদার কথা। আমরা মনে করি এই চাহিদা গুলো যদি পূরণ হয়ে যায় তাহলে সুখি হয়ে যাবো। কিন্তু বিশ্বাস করুন এই চাহিদা পূরণ হলে আপনি বর্তমানের চেয়ে আরও বেশী অসুখী হয়ে পরবেন। কারণ নফস নামের পশুটার ক্ষুধা কখনো কমেনা। ওকে যত খাওয়াবেন ওর খিদেটা বাড়তে থাকবে। প্রতিবার আগের বাড়ের তুলনায় বেশী খাবার চাইবে। আমরা নফস এর এই চাহিদা গুলোকে পুরন করার চেষ্টা করছি বলেই আমরা দিন দিন নফস এর গোলাম হয়ে যাচ্ছি। নফস কে আমাদের গোলাম বানানোর একমাত্র উপাই হলো একে বেশী বেশী ক্ষুধার্ত রাখা। এর চাহিদা গুলো যত সম্ভব কম পূরণ করা।

কিন্তু, এই জগতে হায়, সেই বেশী চায়; আছে যার ভুড়ি ভুড়ি

Happiness
নিজেকে সব সময় বলুন, আমার যা আছে আমি তাই নিয়েই সুখি।

আমরা কিভাবে সুখি হতে পারি?

চলুন একটা গল্প বলি। গৌতম বুদ্ধের কাছে একবার একজন বলেছিলঃ “I want to be happy” অর্থাৎ আমি সুখি হতে চাই।

সে উত্তরে বলেছিল। যদি তুমি সুখি হতে চাও তাহলে সবার আগে তোমার বলা বাক্যটা থেকে “I” বা “আমি” শব্দটা বাদ দিয়ে দাও। কারণ এটা আমিত্ব বা অহমিকা প্রকাশ করে।

এরপর তুমি “want” বা “হতে চাই” শব্দটাকে মুছে ফেল। কারণ এটা আকাংখা বা চাহিদার প্রকাশ করে (অর্থাৎ নফসকে উস্কে দেয়)।

তারপর যেটা অবশিষ্ট থাকে তা হলো “be happy” বা “সুখি”।

এখান থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে আমারা যদি সুখি হতে চাই তাহলে আমাদেরকে আমিত্ব ভাব বা অহংকার, অহমিকা কে বিসর্জন দিতে হবে। এরপর নফসকে আমাদের গোলাম বানাতে হবে। তাহলেই আমরা সুখি হতে পারবো। যত বেশী চাইবেন তত বেশী অসুখী হয়ে পরবেন। যত অল্পত্বে শুকরিয়া আদায় করবেন তত বেশি সুখি হবেন।

তাই আজ থেকেই আল্লাহ্‌র কাছে বেশী বেশী শুকরিয়া আদায় করতে থাকুন। বেশী বেশী তৃপ্ত অনুভব করার চেষ্টা করুন।

  • সকাল বেলার সূর্যটা উঠা দেখে খুশি হোন
  • বৃষ্টির পানি গুলোর রিমঝিম নিত্য দেখে এক্সাইটেড হোন
  • অনেক বেশী রোদ উঠলেও সাদা মেঘ অথবা নিল আকাশটার দিকে তাকিয়ে খুশি হোন।
  • গোধূলি বেলায় যখন সুর্যটা আকাশটাকে রাঙ্গিয়ে দিয়ে বিদায় নেয় সেটার মাঝেও যে এক বিদায় বেদনার সুখ আছে সেই সুখ অনুভব করুন।
  • আপনি বেঁচে আছেন এজন্যও শুকরিয়া আদায় করুন।
  • ভাবুন তো একদানা খাবার আপনার কাছে আসতে কত গুলো মানুষের পরিশ্রম আছে, আল্লাহর কত নিয়ামত আছে, কতগুলো দিনের সূর্যের তাপ, বৃষ্টির পানির অবদান আছে। তাই তিনবেলা খেতে পারছেন ভেবেও সুখি হোন।
  • অনেক মানুষের চেয়ে হয়তো আপনার কম আছে। সেটা দেখে অসুখী না হয় যাদের চেয়ে আপনার বেশী আছে তাদের দিকে তাকিয়ে সুখি হোন।।
  • আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এই লেখাটা পড়তে পারছেন বলেও খুশী হোন। কত মানুষ তা পারেনা ভাবুন তো একবার…

সুখি হওয়াটা আসলে মনের একটা ইচ্ছা। আপনি যদি চান অর্ধপূর্ন গ্লাসের খালি অংশের দিকে না তাকিয়ে, গ্লাসের পূর্ন অংশের দিকে তাকাবেন তাহলেই আপনি সুখি হবে। নাই নাই, চাই চাই করে কখনো সুখ আসেনা। নিজের চাহিদা গুলোকে প্রাপ্তির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখায় সুখ। এজন্যই হয়তো শ্রদ্ধেয় কামিনী রায় বলে গেছেনঃ

‘সুখ-সুখ’ করি কেঁদো না আর;
যতই কাঁদিবে যতই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।

আজকে এপর্যন্তই। ভালো থাকুন, সুখি থাকুন, সকলকে সুখি রাখুন। আল্লাহ্‌ হাফেজ। 😊😊😊

Riham
Riham

আমি একজন সাধারণ ভাবনার সাধারণ ছেলে, যে গল্প বলতে ও গল্প শুনতে ভালোবাসে। কর্ম জীবনে যতটা এগিয়েছি সেটা পালনকর্তা দয়া ও ভালোবাসায়। একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা আমার। নিজের অবস্থানটা নিজে গড়িয়েছি বলেই পরিচয় দিই, তবে তা সঠিক নয়। উঠে আসার পেছনে অনেক মানুষের হাত আছে, অনেক গুলো অন্তরের দোয়া আছে আর স্রিষ্টিকর্তার দয়া আছে। গুরতর অসুস্থতা এবং এক্সিডেন্ট এ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি কয়েকবার। যে দিন গুলো কাটাচ্ছি সেগুলো বোনাস সময়। তাই বেশী ভাবনা চিন্তার তোয়াক্কা না করে মন চাইলেই বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পরি পাহাড়ের ডাকে সারা দিতে, ঝর্নার সাথে মাখামাখি করতে, অথবা ভাবনা গুলোকে নোনাজলে প্রশান্ত করতে। ছবি তুলতে ভালোবাসি, অবসরে অথবা গভীর রাতে একা বসে ভাবতে ভালোবাসি, প্রকৃতি দেখতে এবং বোঝার চেষ্টা করতে ভালোবাসি, গান শুনতে ও গলা মেলাতে ভালোবাসি। টিভি সিরিজ আর মুভি দেখার নেশা আছে কিছুটা। বাকি পরিচয়টা না হয় গল্পে গল্পে দেওয়া যাবে। 😊😊😊

Leave a Reply