একটা সময় ছিল যখন আমি দিন ও রাত মিলে ১২-১৬ ঘণ্টা একটানা ফ্রিল্যান্সিং করতাম। কিন্তু বাল্য বয়সে এই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিরুদ্ধে অপরিণত শরীর আন্দোলন শুরু করতে খুব বেশী সময় নেয় নি। বছর দুয়েক এর মধ্যেই ২০১৫ সালের শেষের দিকে আমি অসুস্থ হতে শুরু করি। কিন্তু সময়টা তখন অনেক কঠিন ছিল বলে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। সেই কঠিন দিন গুলোর গল্প শোনাবো অন্য একদিন। আজ বলবো ২০১৭ সালের শেষের দিকের কথা যখন আমি দীর্ঘ ২ বছর অসুস্থ থাকার পর জীবনকে নতুন করে শুরু করার সুযোগ পাই। আলহামদুলিল্লাহ্! সেই থেকেই সিদ্ধান্ত নিই জীবনে আর কখনো চাপ নিবনা। যে কয়টা দিন বাঁচবো মানুষের মত করে বাঁচবো, নিজেকে ভালবাসবো, স্রিস্টিকর্তাকে ভালবাসবো, তার সৃষ্টিকে ভালবাসবো, পরিবারকে সময় দিব, জীবনটাকে নতুন করে গুছিয়ে নিব। বাল্যকালের সমাপ্তি এবং পরিণত মানসিকতার শুরুটা হয় এই সিদ্ধান্ত নেবার পরেই। শুরু হয় নতুন এক জগতে নিজেকে আবিষ্কার করার গল্প। সেই গল্পের একটি শ্রেষ্ঠ অধ্যায় শোনাবো আজ। 😌 😌 😌
ভারত থেকে চিকিৎসা শেষ করে সবে ফিরেছি। ১২ মাস একটানা ওষুধ খেতে হবে তার ২ মাস কেবল গেছে। Upwork এ যে কয়টি ক্লায়েন্ট ছিল তারা আমার অনুপস্থিতিতে অনেকেই খারাপ ফিডব্যাক দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু এতদিনে আমি এসব ব্যাপারে কেয়ারলেস হতে শিখে গেছি। ফরহাদ ভাইয়ের সাথে সম্পর্কটা তখন বেশ জমজমাট। অনলাইন পেশার এই জগতে যে কয়জনকে চিনি তার মধ্যে অত্যন্ত কাছের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী উনি। একদিন দুইজনে বসে গল্প করছি আর ফেসবুক ব্রাউজ করছি। A4 tech mouse এর খটখটে হুইলারটা ঘুরাতেই নিউজফিডের স্ক্রলবারটা সরে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল বাউন্ডুলে গ্রুপের এক পোস্ট এর সাথে। গ্রুপ লিডার আবু-বক্কর সিদ্দিক ভাই একটি ইভেন্ট খুলেছেন ৩ দিনের জন্য সফর হবে বান্দরবন এ। কি সব ট্র্যাকিং ফ্রেকিং এর কথা বলছে তারা, সে সময় এসব কিছুই আমার কাছে অপরিচিত। ফরহাদ ভাই জেদ ধরে বসলোঃ “ভাই চলেন এই সুযোগে বান্দরবন, আমিয়াখুম, নাফাখুম এগুলো ঘুরে আসি”
আমি মনে মনে ভাবলাম ধেত্তেরি কি সব খুম, খুং শুরু করলো। এগুলার নামই শুনিনি জীবনে। কোন কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। তখন মানসিক অবস্থা এমন যে একটু ফান, ইন্টারটেইনমেন্ট এর যে কোন একটিভিটির কথা বললেই আমি এক পায়ে খাড়া 😀 কি আর করার, রাজি হয়ে গেলাম। যে কথা সেই কাজ, বুকিং দিয়ে দিলাম। বাসের টিকেট কনফার্ম, দিন গুনা শুরু। কয়েকদিন অপেক্ষার পর সেই কাঙ্ক্ষিত সময় আসলো। আমি আর ফরহাদ ভাই নির্ধারিত দিনের ২ দিন আগেই গেলাম ঢাকায়। সেখানে থেকেই বাউন্ডুলে গ্রুপের আরও প্রায় ৩৮-৪০ জনের সাথে যুক্ত হয়ে রওয়ানা হব। 😇 😇 😇
যেহেতু একদিন আগেই গেছি তাই ভাবলাম ওখানে গিয়ে ভাই-ব্রাদারদের অফিস ভিজিট করি। আমরা দুইজনে এর ওর অফিসে ঘুরতে লাগলাম। অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটেই মহাখালী, DOHS এ সালেহ আহমেদ ভাইয়ের অফিসে গেলাম ঘুরতে। একই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার সুবাদে ভাইয়ের সাথে ফেসবুকের কল্যাণে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। তবে এটাই আমাদের প্রথম সামনা সামনি দেখা হলো। ভাই বেশ খাতির, যত্নও করলো। উনার প্রতিষ্ঠান এর একটা করে পলো শার্ট গিফট করলো দুইজনকেই। ঘণ্টা দুইয়েক এর আড্ডার পরে আমরা হোটেলে ফিরে আসলাম। রাত ১২ টার দিকে একটা নির্ধারিত স্থানে সবাই একত্রিত হলাম। বাসে চড়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। উদ্দেশ্য বান্দরবন। আমি বাসে চড়তে অভ্যস্ত না তাই মোশন সিকনেস হয় এবং বমি পায় (এ নিয়ে সুযোগ পেলেই অনেকে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে)। বাসের সিটে বসেই শুয়ে ঘুমানোর ভান করে থাকলাম। তখনো কি জানতাম যে জীবনের সেরা কিছু মুহূর্তের সাক্ষি হতে যাচ্ছি শিগ্রই? 😁
কিছুক্ষণের মধ্য ঢাকার কলোহল পার হয়ে কাচপুর ব্রিজের কাছাকাছি এসে চোখ লেগে আসলো। ঢাকা-চিটাগং হাইওয়ে ধরে গাড়িটা অশ্ববেগে ছুটে চলেছে।২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, ফাগুণ শুরু হয়েছে তখন। বসন্তের শুরুতে হালকা শীতের লেশ যুক্ত উদাস হাওয়া যে কাউকে ঘুম পারিয়ে দিতে পারে অল্পক্ষণেই। কখন ঘুমিয়ে গেছি নিজেই জানিনা। ঘুম ভাঙ্গলো একদল বাইকারদের হর্নের শব্দে। ড্রাইভারের সিটের মোটামুটি পেছনের সিটে বসা আমি গুরমুরি খেয়ে জেগে দেখি পাশের সিটে ফরহাদ ভাই আমার আগেই জেগে উঠেছে। ড্রাইভারের মাথার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বুঝলাম, রাস্তায় বিভীষিকাময় জাম বেঁধেছে। এই জামে বাস-ট্রাকের চিপার ভেতর দিয়ে একদল বাইকার আমাদের সাথেই ছুটে চলেছে বান্দবন অথবা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। প্রায় ১৫-২০ জন হবে। তাদের হর্নের শব্দেই আমার এই নিদ্রাভঙ্গ। প্রথমেই ভ্রু কুচকালেও একটু পরেই নস্টালজিক হয়ে পড়লাম যখন ফরহাদ ভাই বললোঃ “চলেন ভাই এই টুর থেকে ফিরে আমরাও বাইকে টুর দেওয়া শুরু করি”। আগে থেকেই আমার বাইক চালাতে ভালো লাগে তাই বাইক টুরের কথা ভাবতেই এক চনমনে উত্তেজনা শরীরের প্রতিটা লোমকূপকে সংকোচিত করে ফেললো, মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতিটা লোম দাঁড়িয়ে গিয়ে এক অদ্ভুত চনমনে অনুভূতি খেলে গেলে নিমেষেই। শরীর কিছুটা ঝাঁকি দিতেই আমি নড়েচড়ে বসলাম। সেই উত্তেজনায় ভাটা পড়লো যখন গাড়িটা আবারো হর্ন দিয়ে চলতে শুরু করলো…।
আস সলাতু খাইরুম মিনান নাউম…। সারারাত বেশ ঘুম দিলেও ভোর বেলা আশেপাশে থেকে ফজরের আযানের মুখরিত সুর ভেসে আসতেই জেগে উঠলাম। কিছুটা স্বাভাবিক হতেই বুঝলাম আমরা “সাতকানিয়া” থেকে বান্দরবন রুটে পাহাড়ি রাস্তায় প্রবেশ করেছি। তাই এই উঁচুনিচু রাস্তায় নাগরদোলার অনুভূতি হচ্ছে। এবার আমি বেশ কিছুটা উপভোগ করতে লাগলাম। কিন্তু সেই মহেন্দ্রক্ষন আর দীর্ঘ হলোনা। আবার জাম 😩 😩 😩 বসন্তের শুরুতে দিন বড় হতে শুরু করেছে তাই দক্ষিণাঞ্চলে সুর্যটা ভোরের রেশ কাটার আগেই মিষ্টি রোদ ছড়ানো শুরু করে। কিন্তু বেলা কিছুটা বাড়তে লাগলে সেই মিষ্টি রোদ চিটমিটানি গরমের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার মধ্যে জামে আটকে থেকে ততক্ষণে আমার গা গোলানো শুরু হয়ে গেছে। বুঝলাম শরীরটা ভালো লাগছেনা। কিন্তু সারারাত ঘুমানোর পর এই সময় আর ঘুমের মাসি-পিসিরাও ঠিক কথা শুনছেনা। চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম বান্দরবন পৌঁছানোর…।
ঘণ্টা দুয়েক পর বান্দবন এ নামিয়ে দিল। এখনো পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে থাকলেও এই পর্যায়ে এসে আর শরীর কথা শুনলোনা। রাতে যে ভয়ে ঠিকমত খাইনি সেই ভয়টায় বাস্তব হলো বাস থেকে নামার পর, কি আর করার একটু সাইডে গিয়ে কাজ সেরে ফেল্লাম 😜 (আগেই বলেছিলাম বাসে আমার বমি হয় 🥺 )। তবে বমি করার পরেই খুব ফ্রেশ লাগে, হাত-মুখ ধুয়ে এসে আমিতো পুরাই চাঙ্গা। ভাবলাম যা হবার হইছে। অবশেষে অন্তত পৌঁছলাম। আমার সেই আশায় হতাশার ছাই ঢাললো আবু বক্কর সিদ্দিকি ভাই। উনি বললো এখন আমরা খেয়ে দেয়ে আবার বাসে উঠবো 😳 😳 😳 আরে ভাই আবার কেন বাসে? 😭 😭 ফরহাদ ভাই বললো “চিন্তা করেন না বেশীদূর রাস্তা নাই।” আমরা এখন বাসে চড়ে থানচি পর্যন্ত যাবো। আমি বাসে উঠার কথা শুনে আর খেলাম না (খেয়ে কি লাভ? ঢেলেই তো দিব 😢)। উঠলাম বাসে, চলতে শুরু করলো পাহাড়ি রাস্তা ধরে। এবার আর ঘুমাইনি, যা হবার হবে আমিও দেখবো মোশন সিকনেস এর একদিন আর আমার যে কয়দিন লাগে 😡😡
ঘণ্টা দুই তিনেক চলার পর যখন চিম্বুক পাহাড়ে বাস বিরতি দিলো তখন বুঝলাম আমি হালকা তন্দ্রায় আছন্ন হইছিলাম। যাত্রা বিরতিতে বাস থেকে নেমে ঘোর কাটতেই ফিল করলাম যে কানে শুনতেছিনা, কেন জানি শুধু বো বো করতেছে, মনে হচ্ছে কান জাম হয়ে আছে। প্রথমে কান চুলকে শোনার ক্ষমতা ঠিক করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফরহাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখে বুঝলাম এই সমস্যা তার ও হচ্ছে এবং সেও কান চুলকে ঠিক করার এই বৃথা চেষ্টা করে আমার আগে ব্যার্থ হয়েছে 😜 তখন বুজলাম যে এটা অন্য কিছু। পরিচিত হলাম Altitude sickness এর সাথে ( পুরাণ পাগলে ভাত নাই নতুন পাগলের আমদানি) অল্টিটিউড সিকনেস হচ্ছে একধরণের শারীরিক অবস্থা যা হুট করে অনেক উঁচুতে উঠে গেলে অনুভব হয়। অনেকের এই সমস্যা থেকে মাথা ঘুরে বমি হতে পারে। তবে আমার ক্ষেত্রে দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই সব কিছু আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। 😁 বুঝতে পেরে খুশি হলাম যে মানসিক ভাবে কিছুটা শক্ত হচ্ছি 🤣 🤣 🤣
চিম্বুক পাহাড় পার হবার পর আমার জন্য কি অপেক্ষা করছিল তা আমি তখনো আন্দাজ করতে পারিনি। সে এক নতুন জগৎ, এক নতুন বাংলাদেশ, এক টুকরো সবুজ সোনার বাংলাদেশ। আমাদের দেশের প্রকৃতি যে এত সুন্দর হতে পারে এটা আমি আগে কখনো ভাবিনি। কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিল ভিন্ন কোন দেশে চলে এসেছি। সারি সারি পাহাড় গুলো যেন দৌত্যর মত সগৌরবে তার চিরহরিৎ তরুণী কন্যাকে উঁচিয়ে ধরে আছে। আর বিস্তীর্ন সেই সৌন্দর্যে সুর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পরছে ধোঁয়াটে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘমালায়। সেই দানব সাড়ির বুক, পিঠ চিড়ে বানানো হয়েছে পিচঢালা সরু রাস্তা। শীতল পাথরে জলীয় বাষ্প ঠাণ্ডা হয়ে যে চোয়ানো পানি গড়িয়ে আসছে সেই পানিতে কোথাও কোথাও রাস্তা ভিজে আছে। কোথাও আবার সেই পানির ক্ষীণ ধারা সৃষ্টি করেছে ছোট-বড় ঝিরি। বড় ঝিরি গুলো গিয়ে মিশছে সাঙ্গু নদীর স্বচ্ছ পানিতে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সর্পীল সরু রাস্তা ধরে আমাদের মিনি বাসটা কখনো ব্রেক কষে ঢালু পথে নামছিল, আবার কখনো ইঞ্জিনের উচ্চ শব্দ করে উঁচু পাহাড়ে নিজেকে টেনে তুলছিল। যাত্রাপথে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সাঙ্গু নদীর এই উঁকি ঝুঁকি যেন আমার মুগ্ধতাকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি ভুলে গেছিলাম মোশন সিকনেস এর কথা ভুলে গেছিলাম অল্টিটীউড সিকনেস এর কথা, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলাম মিনি বাস এ আটোসাটো সীটে খিচ মেরে বসে থাকার কষ্টটা। তখন শুধু একটায় চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল আসলেই কি প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে…? সুবহানআল্লাহ!!! আলহামদুলিল্লাহ্!!!
বসন্তের ঝিমধরা দুপুরে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আবার খানিকটা চোখ লেগে আসছিল ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েও নিয়েছি বোধহয়, কে জানে? ঘুম ভাঙ্গল বলি পাড়া বিজিবি ক্যাম্পের সামনে এসে। বলি পাড়া একটা ইউনিয়ন। তুলনামূলক জনবসতি পূর্ন জায়গা এবং কিছুটা সমতল ভূমিতে স্থানীয় লোকেরা চাষাবাদ করছে। পাহাড়ের চেনা পরিবেশ এখানে কিছুটা বিরতি দিয়েছে। মনে হচ্ছিল এক লম্বা ক্লান্তিকর যাত্রার পর যেন খানিকটা সমতল ভূমির দেখা পেলাম। সেখানেই এই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এর ক্যাম্প এবং চেকপোস্ট। আমাদের টিম লিডার আবু বক্কর সিদ্দিক ভাই আমাদেরকে আগেই ফেসবুক গ্রুপে জানিয়েছিলেন সবাই যেন সাথে করে আইডি কার্ড নিয়ে আসি এবং সেটার ফটোকপি সাথে রাখি। আমি ভেবেছিলাম ঘুরতে গিয়ে আবার আইডি কার্ড লাগবে কেন, তবুও পাসপোর্ট সাথে রেখেছিলাম। এতক্ষণে বুঝলাম কোথায় কাছে লাগবে আইডি কার্ড। এখানে পুরো বাস চেক করা হবে এবং প্রত্যেকের নাম এন্ট্রি করে আইডি কার্ড জমা নেওয়া হবে। কারণ এরপরেই শুরু হতে চলেছে একদম ওয়াইল্ড পাহাড়ি এলাকা যেখানে জনবসতি কম তাই এই সামন্য ফরমালিটিস টুকু করতেই হবে নিরাপত্তার স্বার্থে। পাহাড়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় প্রবেশের সময় এমন অনেক জায়গাতেই এরকম চেকইন-চেকআউট করতে হয়। নাম এন্ট্রি সেরে আবার রওয়ানা হতে প্রায় ৪৫ মিনিটের মত সময় লেগে গেলো। ততক্ষণে বাসন্তী সূর্যেটা পশ্চিম আকাশে ঢলতে শুরু করেছে।মাঝে মাঝে সাদা-কালো মেঘের সারির ওপার থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। চেকপোস্টের এখানে ধুলাময় পরিবেশে বেশ বিরক্তকর কেটেছে এই সময়টা।
এই গল্পের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র ফরহাদ ভাই হচ্ছেন দানবীয় প্রকৃতির মানুষ। তাকে সহজে টলানো যায়না, যে কোন প্রতিবন্ধকতা তাকে স্পর্শ করে সবার শেষে। তার মানসিক এবং শারীরিক জোর অত্যন্ত বেশী তাই তার মধ্যে বিরক্তির ছাপ সহজেই ফুটে উঠেনা। খুব বিরক্ত না হলে তার ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে বোঝার উপাই নেই যে সে বিরক্ত। এরকম এক্সট্রোভার্ট ব্যাক্তিত্বের মানুষ গুলো কল্পনা প্রবণ কম হলেও তাদের শক্ত মানসিকতা, প্রাক্টিক্যাল চিন্তাভাবনা, অন্যের সাথে সহজেই মিশে যাওয়ার ক্ষমতা, সোশালাইজেশন এর আগ্রহ এবং অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে তাদের ওপর ভরসা করা যায় অতি সহজেই। সে এসব সৌন্দর্য দেখে কল্পনার জগতে কতটুকু হারিয়েছে সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু যাত্রাপথে উনি স্রিস্টিকর্তার এমন সুন্দর সৃষ্টির প্রশংসা করতে কিন্তু একবারো ভোলেন নি। মনোমুগ্ধকর কিছু চোখে পড়লেই সবার আগে “আলহামদুলিল্লাহ্!” উনিই বলেছেন। 😇 😇 😇
বলি পাড়ার সমতল ভূমির পরে শুরু হলো নতুন এক সৌন্দর্যের আনাগোনা। এদিকের পাহাড় গুলোতে সামরিক বাহিনীর তৎপরতার কল্যাণে রাস্তার দুই ধারে গড়ে উঠেছে বড় বড় দেশীয় ফলের বাগান, বিশেষ করে আমবাগান। এখানে তুলনামূলক জুম চাষের পরিমাণ ও বেশী। আর যেখানে জুমচাষ হবে সেখানে জুমঘড় তো থাকবেই। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের বুকে সবুজ চাদর বিছানো জুমক্ষেত গুলোর ফাঁকে ফাঁকে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা জুম ঘর গুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন এখানে একটা ল্যাপটপ, ইন্টারনেট আর বেসিক কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র দিলে থেকে যেতে পারতাম বছরের পর বছর। বৃদ্ধ বয়সে জুমচাষী হবার স্বপ্নও দেখেছি কয়েকবার। তবে এই সময়টায় কোন কোন জুমক্ষেত চাষযোগ্য করার জন্য আগুণ লাগিয়ে ঝাউ পোড়ানো হচ্ছিল যা সবুজ সৌন্দর্যে কার্বন রুক্ষতার জন্ম দিচ্ছিল মাঝে মাঝেই। 😔😔😔
দেখতে দেখতে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। অল্পখানিকটা পথ বাকি আছে শুনে যেই যাত্রা শুরু করেছিলাম সেই রোমাঞ্চকর দীর্ঘ প্রায় ৭৬ কিলোমিটার যাত্রার ইতি ঘটে থানচি বাজারে পৌঁছার পর। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা নামে নামে ভাব। বসন্তের শুরুতে গোধূলি গড়ায় বর্ষাভরা নদীর স্রোতের বেগে। থানচির এই বাজারের পর আর রাস্তা চোখে পড়ছিল না। মানে এখানেই পথের শেষ, এরপর এগোতে হলে পায়ে হেঁটে এগোতে হবে। (যদিও পরবর্তিতে নতুন রাস্তা নির্মানের কাজ শুরু হয়েছে)। বাস থেকে নামার পরেই আমাদের টিম লিডারের মধ্যে এক অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম; তখনো বুঝতে পারিনি সমস্যাটা কি।টিম লিডার সবার খাবার ব্যবস্থা করতে বললেন। বমির ভয়ে সারাদিন না খেয়ে ততক্ষণে আমার পেটে ইঁদুরের দৌরাদোড়ি থেমে বাঘের গর্জন শুরু হয়ে গেছে। খাবার নিতে গিয়েই পরিচয় হলো বাউন্ডুলে গ্রুপের মডারেটর দি জেন্টলম্যান অভি ভাই এর সাথে। সাদা ভাত আর মুরগির ঝোল দিয়ে সে খাবার সে সময় আমার কাছে অমৃত মনে হচ্ছিল। 🤗🤗
খাওয়া শেষে লক্ষ করলাম রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচু যে জায়গাটায় বসে আমি এতক্ষণ খাচ্ছিলাম সেটা আসলে পুলিশ স্টেশন এর বাহিরের ফটক।😄 ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম পুলিশের রুমের স্যামনে আমাদের টিম মেম্বারদের ভিড় জমে গেছে আর টিম লিডার এক লিকলিকে গোছের হাড্ডি গুড্ডি বেড়োনো স্থানীয় লোককে সাথে নিয়ে পুলিশের রুমে গিয়ে অনুরোধ করছেন আমাদের কে ট্র্যাকিং এ যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য। আশেপাশে দুই চারজন বলাবলি করছিল যে আমাদের অনেক বেশী দেরী হয়ে গেছে পৌঁছাতে। ফরহাদ ভাই পুরো ঘটনা বুঝে এসে আমাকে বললো যে আমরা পায়ে হেঁটে অনেক গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবো তাই বিকাল ৩ টার পর পুলিশ চেকপোস্ট থেকে আর অনুমতি দেয়না। সেখানে আমাদের প্রায় বিকাল ৫ টা বেজে গেছে। সম্ভবত আজকে আর অনুমতি পাওয়া যাবেনা, সেই ক্ষেত্রে আমাদেরকে আগামীকাল যেতে হবে। আমি এসবের তোয়াক্কা না করে ভাবলাম “ধুর আমার যা সৌন্দর্য দেখার তা তো দেখেই নিয়েছি ভেতরে গিয়ে আর কি হবে”। তার মধ্যে সারাদিন পর পেটে খাবার পড়েছে তখন আমি পুরাই উরাধুরা মেজাজে আছি। কিন্তু তখনো আমি অনুধাবন করতেই পারিনি যে আমি আইস বার্গের কেবল ওপরের অংশটুকুই দেখছি। এখনো আসল সৌন্দর্য অন্ধকারেই রয়ে গেছে। তখনো আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার সামনে এডভেঞ্চারে পরিপূর্ন কি এক বিরাট রাত অপেক্ষা করছে। পরবর্তি কয়েকদিনের জন্য থানচির গহিনে আমি প্রবেশ করতে চলেছি এক অপরূপ সৌন্দর্যে সাজানো লীলাভূমিতে।
প্রথম পর্ব এপর্যন্তই ফিরে আসছি একটি বিরতির পর। আগামী পর্বের জন্য চোখ রাখুন আমার ব্লগে এবং আমার ফেসবুক পেজে। সব শেষে আপনাদের জন্য একটা প্রশ্ন রেখে যাই। অনুমান করে কমেন্টে জানান “সেদিন কি আমরা পুলিশের কাছে অনুমতি পেয়েছিলাম? নাকি, সেদিনের মত আমাদেরকে পুলিশ স্টেশনেই রাত কাটাতে হয়েছিল পরেরদিন যাত্রা শুরুর উদ্দেশ্যে?” 😁 😄 😃
এই ভ্রমণ কাহিনীর সিরিজ লিখতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে গিয়ে আমি এই জায়গায় আবার ঘুরতে গেছিলাম। তাই আপাতত আর এই সিরিজ কন্টিনিউ না করে সেম জায়গায় একদম নতুন ট্যুরের অভিজ্ঞতা নতুন ভাবে শেয়ার করবো।